যেসব গরুকে কাঁচা ঘাসজাতীয় খাবার বেশি খাওয়ানো হয়, সেসব গরুর মাংসে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ অন্যান্য মাংসের চেয়ে বেশি থাকে। শুকনো খাবার খায় যে গরু তার মাংসে উপকারী ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড নেই বললেই চলে। তাই কোরবানির গরু কেনার সময় যে গরুকে কাঁচা ঘাস খাওয়ানো হয়, সেই গরু কেনা ভালো। প্রতি ৪ আউন্স (১১৩ গ্রাম) মাংস আমাদের প্রতিদিনের ভিটামিন ও খনিজ লবণের চাহিদার নিম্নলিখিত অংশ পূরণ করে : পুষ্টি উপাদান পূরণকৃত চাহিদা, ভিটামিন বি-১২ ৬০ শতাংশ, আমিষ ৫২ শতাংশ, ভিটামিন বি-৩ ৪৭ শতাংশ, ওমেগা-৩ ফ্যাট ৪৬ শতাংশ, ভিটামিন বি-৬ ৪৪ শতাংশ, সেলেনিয়াম ৪৩ শতাংশ, জিংক ৩৭ শতাংশ, ফসফরাস ৩৪ শতাংশ, আয়রন ২৭ শতাংশ, কোলাইন ১৭ শতাংশ প্যান্টোথেনিক এসিড ১৫ শতাংশ
মাংসের ক্যালরিমূল্য- প্রতি ১০০ গ্রাম মাংস থেকে রকমভেদে ৪৯৮ থেকে ৫১৪ কিলোক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। তাই শক্তির জন্য মাংস খাওয়া যায় সপ্তাহে এক বা দুই দিন। যাদের ওজন কম তারা ওজন বাড়াতে (যদি কোনো শারীরিক সমস্যা না থাকে ) নিয়মিত মাংস খেতে পারে।
বিভিন্ন অঙ্গ থেকে প্রাপ্ত পুষ্টি উপাদান
গরু অথবা খাসির বিভিন্ন অঙ্গে আছে নানা রকম পুষ্টিগুণ। লিভার, হার্ট, কিডনি ও মগজ নানা রকম ভিটামিন ও খনিজ লবণে বেশ সমৃদ্ধ।
♦ সব রকমের অর্গান মিটে ভিটামিন বি-১২ আছে প্রচুর পরিমাণে। প্রতি ১০০ গ্রাম অর্গান মিট প্রতিদিনকার ভিটামিন বি-১২-এর চাহিদার শতভাগ পূরণ করতে সক্ষম।
♦ লিভার আমিষ, আয়রন, ফলিক এসিড, জিংক, রিবোফ্লাভিন, নায়াসিন ও ভিটামিন এ-এর উত্তম উৎস।
♦ কিডনি আমিষ, আয়রন, থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন ও ফলিক এসিডের ভালো উৎস।
♦ হার্ট থেকে পাওয়া যায় আয়রন ও জিংক, তবে লিভার ও কিডনির তুলনায় কম।
♦ সব অর্গান মিটে প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরল আছে; বিশেষত মগজে কোলেস্টেরলের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
মাংসের মন্দ দিক- মাংসের সঙ্গে যে রোগটির সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক পাওয়া গেছে তা হলো এথোরেসক্লোরোসিস, অর্থাৎ ধমনিতে চর্বি জমাট বেঁধে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা। মনে করা হয়, পশুর মাংসের চর্বি এই রোগের জন্য দায়ী।
চর্বির আধিক্য- কিছু পরিমাণ চর্বি সুস্বাস্থ্যের জন্য দরকার, তবু মাংসের চর্বির মাত্রা শরীরের জন্য খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। তাই মাংস কাটার ও খাওয়ার সময় দৃশ্যমান চর্বি ফেলে দেওয়া ভালো। কেননা অতিরিক্ত চর্বি হার্টের অসুখসহ নানা রকম শারীরিক অসুবিধার কারণ হতে পারে। খাসির মাংসে চর্বির পরিমাণ অন্যান্য মাংসের তুলনায় বেশি। তাই যাদের হার্টের সমস্যা বা ওজন বেশি, তাদের খাসির মাংস পরিহার করা উচিত।
কোলেস্টেরলের উপস্থিতি- মাংসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কোলেস্টেরল থাকে, তাই অনেকেরই মাংস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষত অর্গান মিটে কোলেস্টেরল থাকে বেশি। যেমন গরুর তুলনায় খাসির মাংসে কোলেস্টরল অনেক গুণ বেশি। তাই গরুর মাংস হোক বা খাসি, সুস্বাস্থ্যের জন্য পরিমিত আহারই শ্রেয়।
পিউরিনের উপস্থিতি- মাংসে পিউরিন নামের এক ধরনের উপাদান থাকে, যা সাধারণত উদ্ভিজ্জ খাবার ও মানুষের দেহে পাওয়া যায়। যাদের পিউরিনজনিত সমস্যা আছে, তারা অতিরিক্ত মাংস খেলে শারীরিক সমস্যা হতে পারে। পিউরিন শরীরের ভেতর ভেঙে ইউরিক এসিডে রূপান্তরিত হয়, অতিরিক্ত পিউরিন শরীরে অতিরিক্ত ইউরিক এসিড তৈরি করে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে জমা হয়। ফলে গাউট ও কিডনিতে পাথর জমতে শুরু করে।
স্তন ক্যান্সার ও অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি-
যারা দিনে ১৭০ গ্রাম মাংস খায়, তাদের স্তনসহ অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যারা সপ্তাহে ৩ বা তার চেয়ে কম পরিবেশন মাংস খায়, তাদের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া মাংস প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।
ই-কোলাই দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি-
ই-কোলাই এক ধরনের জীবাণু, যার ফলে ডায়রিয়া, পানিশূন্যতা, পেট ব্যথাসহ নানা রকম সমস্যা হতে পারে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গরু রাখলে এবং গরুর মাংস কাটাকাটি করলে সহজেই গরু এই জীবাণু দ্বারা অক্রান্ত হয় এবং গরুর মাংস খাওয়ার মাধ্যমে তা মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। তাই গরুকে পরিষ্কার পরিবেশে রাখা উচিত এবং গরুর মাংস ভালো করে সিদ্ধ করে খাওয়া দরকার।
কিভাবে রান্না করবেন-
রান্না করার আগে মাংসের মধ্যকার দৃশ্যমান চর্বিগুলো যতটুকু সম্ভব ফেলে দিন। অল্প তেলে মাংস রান্না করুন। রান্নার ফলে মাংসের বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ঘটে। অল্প তাপে এর প্রোটিন জমাট বাঁধে ও নরম হয়। তবে মাংসে কোলাজেন নামক যে পদার্থ থাকে, তা জমাট বাঁধে না। অধিক তাপে মাংসের প্রোটিন কঠিন ও সংকুচিত হয়। সুতরাং বেশি তাপে রান্না না করে অল্প তাপে রান্না করাই ভালো। রান্নার সময় মাংসের ভিটামিন, প্রোটিন ও খনিজ লবণের অপচয় যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখুন। এ জন্য মাংসের টুকরা বড় করলে পুষ্টিমূল্য ঠিক থাকে। তাপে থায়ামিন নষ্ট হয় ৩০ শতাংশ। অল্প তাপে রান্না করলে মাংসের থায়ামিন ঠিক থাকে। মাংসের ঝোলের মধ্যে বি-ভিটামিন দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে।
মনে রাখা ভালো-
কোরবানির ঈদে যেহেতু মাংস একটু বেশিই খাওয়া হয়, তাই এ সময় বিশুদ্ধ পানি পান করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া দরকার। মাংস শরীরে বিপাকপ্রক্রিয়ায় শোষণ হওয়ার পর আমিষের অপ্রয়োজনীয় অংশ কিডনির মাধ্যমে ছেঁকে শরীর থেকে মূত্রের আকারে বের হয়ে যায়। পরিমাণমতো পানি এই কাজে সহায়তা করে। ঈদের কয়েক দিন প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪ গ্লাস পানি পান করা ভালো।
♦ ঈদে মাংসের সঙ্গে কাঁচা সালাদ খান, সঙ্গে লেবু, কাঁচা পেঁপে রাখুন।
♦ প্রতিদিন কিছু সবজি খেতে ভুলবেন না।
♦ কাঁচা পেঁপে ও আনারস আমিষজাতীয় খাবার হজমে সহায়তা করে।
♦ খাওয়া শেষে মৌরি খাওয়া হজমের জন্য ভালো।
♦ খুব বেশি এসিডিটির সমস্যা হলে এক টেবিল চামচ অ্যাপল সিডর ভিনেগার এক কাপ পানিতে মিশিয়ে খেতে পারেন।
REF: প্রথম আলো, যুগান্তর,সকালেরখবর,কালের কণ্ঠ