প্রকৃতির নিয়মে চলে যাচ্ছে বসন্ত। কিছু দিন আগেও যে শীতের আমেজ ছিল তা এখন একেবারেই উধাও। আমাদের দেশ ষড়ঋতুর দেশ। যদিও ষড়ঋতুর প্রকৃত চিত্র শুধু গ্রামাঞ্চলেই দেখা যায়। ইট-কাঠের এই শহুরে জীবনে সারা বছরই ঘুরেফিরে আসে ঠাণ্ডা-গরম। তাই বছরের এ সময়ে প্রকৃতিতে যেমন হঠাৎ করেই এক নতুন রূপের আবির্ভাব হতে দেখা যায়, তেমনি নানা রোগব্যাধিতেও আক্রান্ত হতে হয়। সৃষ্টি হয় নানা রকমের স্বাস্থ্যগত জটিলতার।
হঠাৎ করেই আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে এ সময় ছোট-বড় সবারই জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ সময়ের থেকে অনেক গুণ বেড়ে যায়। মূলত ঋতু পরিবর্তনের ফলে বাতাসে আর্দ্রতার ওঠা-নামার কারণে এ সময়ে জ্বরের প্রকোপ অনেকাংশেই বেড়ে যায়। এ জ্বরগুলোর বেশির ভাগই হয় ভাইরাসজনিত কারণে। আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে বেরিয়েই বাইরের প্রচণ্ড গরমে কাজ করা, আবার রোদে কাজ করতে করতে হঠাৎ করে খুব ঠাণ্ডা পানি পান করলে ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। বিভিন্ন প্রকারের ভাইরাস জ্বর, বিশেষ করে ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ এ সময়ে বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া ঘন ঘন বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি হওয়ার কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে এডিস মশার ডিম পাড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ কারণে ডেঙ্গু জ্বর হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।
ভাইরাস জ্বর কী?
ভাইরাস জ্বর কী তা জানতে হলে সবার আগে আমাদের জানতে হবে ভাইরাস আসলে কী? ভাইরাস হলো এক ধরনের অতিক্ষুদ্র জৈব কণা বা অণুজীব। যারা জীবিত কোষের ভিতরেই বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। এর শরীরে থাকে একটি ডি এন এ অথবা আর এন এ নামক জিন পদার্থ এবং একটি প্রোটিন কোষ। এই ভাইরাসই মানুষ, পশু-পাখি ও উদ্ভিদের নানা প্রকার রোগের জন্য দায়ী। এই ভাইরাসের মাধ্যমে যে জ্বর হয় তাকেই বলা হয় ভাইরাস জ্বর। সাধারণভাবে ভাইরাস জ্বর বলতে ফ্লুকেই বোঝায়। এ জন্য প্রধানত দায়ী ইনফ্লুয়েঞ্জা ‘টাইপ বি’ এবং ‘টাইপ এ’-এর দুটো ভাইরাস।
ভাইরাস জ্বরের লক্ষণ :
ভাইরাস জ্বরের নির্দিষ্ট কিছু লক্ষণ আছে। সাধারণত কোনো ব্যক্তি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার ভাইরাস জ্বর হয় না। মানুষের শরীরে ভাইরাস আক্রমণের কয়েক দিনের মধ্যেই জ্বর দেখা দেয়। ভাইরাস জ্বরের লক্ষণগুলো হলো— শরীরে শীত শীত ভাব, কাঁপুনি, মাথাব্যথা, হাত-পায়ের গিরায় ব্যথা, খাবারে অরুচি, নাক দিয়ে অঝোরে পানি পড়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া, চুলকানি, ঠাণ্ডা ও সর্দিজনিত স্বাস্থ্যগত সমস্যা হওয়া। তবে অনেকের ক্ষেত্রে আবার কিছু ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন— পেটের সমস্যা, বমি ও ডায়রিয়া হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে আবার কিছু ব্যতিক্রম হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে টাইপ ‘বি’ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণে পেট ব্যথাও হতে পারে। ভাইরাস জ্বর সাধারণত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। বাতাসের মাধ্যমে ও আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি থেকেও ভাইরাস জ্বরের সংক্রমণ হতে পারে। ঠাণ্ডা লাগলে বা বৃষ্টিতে ভিজলেও ভাইরাস জ্বরের সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
ভাইরাস জ্বরের চিকিৎসায় করণীয়
ভাইরাস জ্বর সাধারণত তেমন ভয়াবহ কোনো রোগ নয়। তাই ভাইরাস জ্বর হলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। এ জ্বরের জন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের দরকার নেই। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল খেলেই হয়। সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রামও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভাইরাস জ্বরের ক্ষেত্রে। ভাইরাজ জ্বর হলে এ জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে ঘরের ভিতর থাকাই ভালো। কেননা এ জ্বর যেহেতু বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা অন্য সুস্থ লোকেরাও এই ভাইরাস জ্বরের শিকার হতে পারেন। তবে সপ্তাহ খানেকের বেশি সময় ধরে জ্বর দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
জ্বর হলে কী করবেন?
ভাইরাস জ্বর হলে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। সম্ভব হলে পানিতে লবণ বা খাওয়ার স্যালাইন মিশিয়ে নিন। সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম নিন। ভাইরাস জ্বরে অনেকের আবার গলাব্যথা হতে পারে। সেক্ষেত্রে গলাব্যথা কমাতে কুসুম গরম পানিতে আধা চামচ লবণ মিশিয়ে গড়গড়া করে দেখতে পারেন। ভাইরাস জ্বর হলে খাবারের বিষয়ে একটু সচেতন হতে হবে। খাবারের মধ্যে ভিটামিন সি ও জিঙ্কযুক্ত খাবারে প্রাধান্য দিন। সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করুন, সেই সঙ্গে শরীর পরিষ্কার রাখুন, গোসল করুন নিয়মিত। অযথা বৃষ্টিতে ভিজবেন না। শিশুদের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন।
যদিও ভাইরাস জ্বর হলে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, তবে জ্বরের স্থায়িত্বকাল চার-পাঁচ দিনের বেশি হয়ে গেলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডা. সমীরণ কুমার সাহা এমবিবিএস, পিএইচডি (মেডিসিন), এফএসিপি (ইউএসএ), এফআরসিপি (এডিন) ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সিনিয়র কনসালটেন্ট, মেডিসিন বিভাগ ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ঢাকা
REF:bd-pratidin.com